অবরুদ্ধ চতুর্থ মাত্রা

গেন্ডারিয়া রেলপথ

কোনো এক সাহিত্যিকের লেখায় হয়তোবা পড়েছিলাম—ভোরের মলিন হাওয়া, প্রশ্বাসের সাথে তীক্ষ্ণ চুরি হয়ে সব যন্ত্রণা-বিষন্নতা-ক্লান্তির বক্ষ চিরে বের হয়।

এখানে ভোরের হাওয়া নেই, তবে সারা দিনের শব্দ দূষণের তীব্রতা কান দিয়ে প্রবেশ ক’রে নিঃশ্বাস ফেলার কোনো রন্ধ্র খুঁজে পায় না। গত রাত্তিরে থেকে এখন আরেক রাত্তিরে, বিষম মাথাব্যথা প্রশমিত হতে একদমই নারাজ। অর্ধদিন ঘুমোলাম—অর্ধদিন ফোন টিপলাম, কোনো কাজে দিল না। সত্যিকারার্থে আমি নিজেই কেন জানি অসুস্থতাকে প্রশ্রয় দিই।

এভাবে কি আর চলে! রুমমেটকে বললাম, “চল ব্রো, রেললাইন থেকে ঘুরে আসি।” “আমরা দুজন পাগল হ’য়া গেসি” সে বলল।

পাঞ্জাবিটা পরে নিলাম। প্রতিসারকে গিয়ে হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করলাম। গত পরশু বন্ধুরা বলেছিল যে, চুলগুলো আরেকটু বড়ো হলে আমায় নাকি কবিকবি ভাব গ্রাস করবে।

বের হলাম। সিঁড়ি গড়ার আগেই বললাম, “আমরা কত মাস এখানে?” অঙ্ক কষে বলল, “আমার চার মাস হয়ে গেছে। ও! তুমি আর আমি একসাথে এসছি তার মানে তোমার আমার একই।” ভেবেও বিস্মিত হচ্ছি কীভাবে এই স্বাধীন জীবন ইটপ্রাচীরের শক্ত গাথুনিতে আটকে যাচ্ছে। স্বপ্ন ছিল অ্যাঞ্জেল হয়ে ওড়ার—হুাহুাহুা—গহন পাতালের নরকে, এখন।

বস্তির রাস্তা পেরিয়ে, মাদ্রাসার রাস্তা ছাড়িয়ে, ছুটে আসা যন্ত্রকে উপেক্ষা করে পৌঁছে গেলাম রেললাইনে। প্রবেশ তোরণে একটি ছাপড়ি দোকান (বটের রোল, শিকের রোল পরোটা ইত্যাদি বিক্রি হয় যেখানে); প্রতিবার কিছু না কিছু একটা গলাধঃকরণ করতাম। আজ আর তেমনটি নয়। বরং এবার মাটি ছাড়িয়ে পাথর ছাড়িয়ে কংক্রিট ছাড়িয়ে লৌহ; কখনো ধীর কখনোবা ক্ষিপ্র।

আলো এসে পড়ছে, বিভিন্ন প্রকার ভালোবাসার। 
আহ্মারূপ তবে টুপিযুক্ত এক ছেলে তার ছোটো ভাইকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের বন্ধন যেন সূর্য-পৃথিবীর বন্ধন। সূর্য পৃথিবীকে ছাড়াও বাঁচতে পারে কিন্তু তখন সে অকর্মা; তার সৌন্দর্যই পৃথিবীর সজীব-শ্যামল-সতেজ মুখ। আরেকটু সামনে এক অবোধ ছেলের হাত ধরে এক বুঝ-বালিকা—বৃদ্ধ মাকে নিয়ে একজন যুবা—বাদামের করুণায় বেঁচে থাকা দধীচি—একাকী হেঁটে ছলা কর্মব্যস্ত লোক।

চলে এলাম আমাদের সীমানায়। এই সীমানায় এসে মোড় ঘুরাতে হবে একই পদাঙ্কে। এখন ক্ষিপ্রতা ও ধীরতার সংমিশ্রণ নেই; কিছুটা পিছিয়ে পড়লাম। 

আলো এসে পড়ল অন্ধকারের। 
রেল লাইনে উপবিষ্ট এক ছেলের এক ক্ষুদে যন্ত্র তার অতীতকে আটকে রাখার চেষ্টায় মগ্ন; কেউবা হাসছে কেহ আবার নিউট্রালাইজড হয়ে স্থিতি ধর্ষণে ঘষে যাচ্ছে জুতার তলা।

সেরকম তিনজন লোক, তাদের মধ্যে: প্রৌঢ়, বৃদ্ধ ও যুবক। হাসি-তাচ্ছিল্যের সাথে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, “আপনে ত সব বোঝেন, কন, ওইহানে কী লেকসে?”; রেললাইন মেরামতকারীদের ভিনদেশি ধ্বজা দেখিয়ে। “আমরা বাংলাদেশের...।”

স্টেশনের কংক্রিট ছাড়িয়ে ক্ষিতিতে পদার্পণ করলাম। দুপাশের লৌহ শিকল শক্ত করে নয় তবে পেলব আকর্ষণে ধরে রেখেছে। একসময় মাটি শেষ হলে পাথরের গিরিপথে ঢুকে পড়লাম। পুবের বাতাস দীর্ঘ জামাকে গায়ের সাথে লেপে দিচ্ছে। নিজেকে God of Mischief ব’লে মনে হচ্ছে; সব বাধা পেরিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে নিজ শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে একাকীত্বে। God of Mischief নই, তাই এক মৃত পচাপ্রায় কুকুরের সামনে গিয়ে আবারো পদদলিত হয় লৌহ।

রেললাইন এখন অতীত, বর্তমান হচ্ছে ক্ষীণকায় রাস্তাগুলো। পরিষ্কারকারীরা ঝাড়ু দিচ্ছে। চারিপাশের রাত ও ধুলোর অন্ধকারের কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছে ল্যাম্পপোস্টের আলো। নাক-মুখ চেপে, হালকে একটু কেশে—পার হয়ে এলাম।

রুমমেট অন্যপথ ধরল। একাকী হেঁটে চললাম আবারও সেই অবরুদ্ধ চতুর্থ মাত্রায় (যেখানে সিঁড়ি ভাঙ্গার আগের সময় ইঁদুরগুলো যেন আমাকে দেখে একটু বেশিই ভয় পায় কিবা ঘৃণা করে) তোমাদের সাথে দেখা করতে, টেবিল ল্যাম্পের আলোর মধ্যে থাকা সাদা প্রান্তরে আর রবীন্দ্রনাথের:

সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ জেতেছে ভাসি।
              তারি দুচারিটি অশ্রুজল।

—আবৃত্তি করে শোনাতে।

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ